রুট ক্যানেল চিকিৎসা: ভয়ের কারণ নাকি দাঁত বাঁচানোর সেরা উপায়?
ডেন্টাল চিকিৎসার জগতে "রুট ক্যানেল" নামটি শুনলেই অনেকের মনে অজানা এক ভয় কাজ করে। তীব্র ব্যথার এক কাল্পনিক চিত্র আমাদের মনে ভেসে ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই তাই? আধুনিক দন্তচিকিৎসায় রুট ক্যানেল থেরাপি কি সত্যিই একটি ভীতিকর অভিজ্ঞতা, নাকি এটি ক্ষতিগ্রস্ত দাঁতকে রক্ষা করার এবং অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম সেরা উপায়?
ROOT CANALDENTAL SURGERY
Dr Ashraf Ali Bissash Reyad
9/1/20251 min read
সত্যিটা হলো, রুট ক্যানেল সম্পর্কে আমাদের মনে জমে থাকা ধারণাগুলোর বেশিরভাগই পুরোনো দিনের গল্প বা ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। আজকের দিনে, এই চিকিৎসাটি অত্যন্ত সাধারণ, কার্যকর এবং প্রায় ব্যথামুক্ত একটি প্রক্রিয়া। এটি কেবল আপনার দাঁতকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকেই বাঁচায় না, বরং আপনার স্বাভাবিক হাসি এবং খাওয়ার ক্ষমতাকেও ফিরিয়ে দেয়।
চলুন, আজ আমরা রুট ক্যানেল চিকিৎসার গভীর থেকে ঘুরে আসি, এর প্রতিটি ধাপ সম্পর্কে জানি এবং এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো ভেঙে ফেলি।
কেন রুট ক্যানেল থেরাপির প্রয়োজন হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের প্রথমে দাঁতের গঠন সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে। প্রতিটি দাঁতের মূলত তিনটি স্তর থাকে: ১. এনামেল (Enamel): বাইরের সবচেয়ে শক্ত, সাদা আবরণ। ২. ডেন্টিন (Dentin): এনামেলের নিচে থাকা কিছুটা নরম স্তর। ৩. পাল্প (Pulp): দাঁতের একেবারে কেন্দ্রে থাকা নরম টিস্যু, যেখানে রক্তনালী, নার্ভ বা স্নায়ু এবং যোজক কলা থাকে। এই পাল্পই দাঁতকে জীবন্ত রাখে এবং ঠান্ডা বা গরমের অনুভূতি প্রদান করে।
যখন কোনো কারণে, যেমন—গভীর ক্যাভিটি বা দাঁতের ক্ষয়, দাঁতে ফাটল, বারবার একই দাঁতে ফিলিং করানো বা কোনো ধরনের আঘাতে দাঁতের পাল্প সংক্রমিত (infected) বা প্রদাহে (inflamed) আক্রান্ত হয়, তখন তীব্র ব্যথা শুরু হয়। এই সংক্রমিত পাল্প যদি সময়মতো অপসারণ না করা হয়, তবে এটি দাঁতের গোড়ায় পুঁজ তৈরি করতে পারে, যা অ্যাবসেস (abscess) নামে পরিচিত। এই সংক্রমণ চোয়ালের হাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে এবং মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এই পর্যায়ে, দাঁতটিকে রক্ষা করার এবং সংক্রমণকে শরীর থেকে দূর করার একমাত্র উপায় হলো রুট ক্যানেল থেরাপি।
যে লক্ষণগুলো বলে দেবে আপনার রুট ক্যানেল প্রয়োজন
তীব্র ও একটানা ব্যথা: বিশেষ করে রাতে বা শুয়ে থাকার সময় ব্যথা বেড়ে যাওয়া।
স্পর্শ বা চাপে সংবেদনশীলতা: খাবার চিবানোর সময় বা দাঁতে সামান্য চাপ লাগলেই তীব্র ব্যথা অনুভব করা।
ঠান্ডা বা গরমে দীর্ঘস্থায়ী শিরশিরে অনুভূতি: ঠান্ডা বা গরম কিছু খাওয়ার পরেও যদি শিরশিরে অনুভূতি দীর্ঘক্ষণ থাকে।
দাঁতের রঙ পরিবর্তন: সংক্রমণের কারণে দাঁতের রঙ কালচে বা ধূসর হয়ে যাওয়া।
মাড়ি ফুলে যাওয়া: আক্রান্ত দাঁতের গোড়ার মাড়ি ফুলে যাওয়া বা একটি ছোট ফোঁড়ার মতো হওয়া, যা থেকে পুঁজ বের হতে পারে।
যদি এর কোনো লক্ষণ আপনার মধ্যে দেখা দেয়, তবে দেরি না করে অবশ্যই একজন ডেন্টিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রুট ক্যানেল চিকিৎসা পদ্ধতি: ধাপে ধাপে
আধুনিক প্রযুক্তি এবং অ্যানেস্থেসিয়ার কল্যাণে রুট ক্যানেল এখন প্রায় ব্যথাহীন একটি প্রক্রিয়া। পুরো চিকিৎসাটি সম্পন্ন হতে সাধারণত এক বা একাধিক সেশনের প্রয়োজন হতে পারে, যা সংক্রমণের তীব্রতার উপর নির্ভর করে।
ধাপ ১: রোগ নির্ণয় ও প্রস্তুতি প্রথমে ডেন্টিস্ট আপনার দাঁতটি ভালোভাবে পরীক্ষা করবেন এবং একটি এক্স-রে করাবেন। এক্স-রের মাধ্যমে দাঁতের ভেতরের রুট ক্যানেলগুলোর গঠন এবং সংক্রমণের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। চিকিৎসা শুরুর আগে, লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া (Local Anesthesia) প্রয়োগ করে আক্রান্ত দাঁত এবং তার চারপাশের অংশ সম্পূর্ণ অবশ করে নেওয়া হয়, ফলে পুরো প্রক্রিয়ায় রোগী কোনো ব্যথা অনুভব করেন না।
ধাপ ২: পাল্প অপসারণ দাঁতটি অবশ হয়ে গেলে, ডেন্টিস্ট দাঁতের উপরের অংশে একটি ছোট ছিদ্র বা অ্যাক্সেস ক্যাভিটি (access cavity) তৈরি করেন। এরপর অত্যন্ত সূক্ষ্ম কিছু যন্ত্র বা ফাইলের (files) সাহায্যে দাঁতের ভেতর থেকে সংক্রমিত বা মৃত পাল্প সম্পূর্ণরূপে অপসারণ করা হয়।
ধাপ ৩: ক্যানেল পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্তকরণ পাল্প চেম্বার এবং রুট ক্যানেলগুলো থেকে পাল্প সরিয়ে ফেলার পর, সেগুলোকে ভালোভাবে পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করা হয়। বিভিন্ন এন্টিসেপটিক সলিউশন দিয়ে ক্যানেলগুলো ধুয়ে (irrigation) দেওয়া হয়, যাতে ভেতরে কোনো ব্যাকটেরিয়া অবশিষ্ট না থাকে। এরপর ক্যানেলগুলোকে সঠিক আকার দেওয়া হয় যাতে ফিলিং উপাদান দিয়ে তা সঠিকভাবে भरा যায়।
ধাপ ৪: ক্যানেল ফিলিং ও সিলিং যখন নিশ্চিত হওয়া যায় যে ক্যানেলগুলো সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত, তখন সেগুলোকে গাটা-পার্চা (gutta-percha) নামক এক ধরনের রাবারের মতো নিষ্ক্রিয় উপাদান দিয়ে পূর্ণ করে দেওয়া হয় এবং সিল করে দেওয়া হয়। এটি পুনরায় সংক্রমণ হওয়া থেকে দাঁতটিকে রক্ষা করে। সবশেষে, দাঁতের উপরের ছিদ্রটি একটি অস্থায়ী বা স্থায়ী ফিলিং দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চিকিৎসার শেষ ধাপ: ক্রাউন বা ক্যাপ স্থাপন
রুট ক্যানেল চিকিৎসার পর দাঁতটি আর জীবন্ত থাকে না, কারণ এর ভেতরের নার্ভ ও রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে, সময়ের সাথে সাথে দাঁতটি ভঙ্গুর বা দুর্বল হয়ে পড়ে। চিবানোর চাপে যাতে দাঁতটি ভেঙে না যায়, সেজন্য এটিকে সুরক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই সুরক্ষার কাজটি করে একটি ক্রাউন বা ক্যাপ। রুট ক্যানেল করা দাঁতের উপর একটি ক্রাউন পরিয়ে দিলে এটি কেবল মজবুতই হয় না, বরং তার স্বাভাবিক আকার, আকৃতি এবং কার্যকারিতাও ফিরে পায়।
রুট ক্যানেল নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা
ভুল ধারণা ১: রুট ক্যানেল খুব যন্ত্রণাদায়ক।
বাস্তবতা: এটি সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা। চিকিৎসার সময় অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহার করার ফলে কোনো ব্যথা হয় না। বরং যে ব্যথা নিয়ে আপনি ডেন্টিস্টের কাছে যান, এই চিকিৎসাই আপনাকে সেই ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়।
ভুল ধারণা ২: দাঁত তুলে ফেলাই ভালো বিকল্প।
বাস্তবতা: প্রাকৃতিক দাঁতের কোনো বিকল্প নেই। একটি দাঁত তুলে ফেললে পাশের দাঁতগুলো স্থানচ্যুত হতে পারে, খাওয়ার সমস্যা হতে পারে এবং চোয়ালের হাড়ের ক্ষয় হতে পারে। পরবর্তীতে সেই ফাঁকা স্থান পূরণ করতে ব্রিজ বা ইমপ্ল্যান্টের খরচ রুট ক্যানেল করে দাঁত বাঁচানোর খরচের চেয়ে অনেক বেশি।
রুট ক্যানেল থেরাপি কোনো ভীতিকর শাস্তি নয়, বরং এটি আধুনিক ডেন্টিস্ট্রির এক আশীর্বাদ। এটি একটি নিরাপদ ও প্রমাণিত চিকিৎসা যা আপনার প্রাকৃতিক দাঁতকে রক্ষা করে, আপনাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় এবং আপনার সুন্দর হাসিটি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তাই দাঁতের ব্যথাকে অবহেলা না করে বা রুট ক্যানেলের ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে, সময়মতো ডেন্টিস্টের শরণাপন্ন হোন। মনে রাখবেন, একটি সংরক্ষিত দাঁত একটি কৃত্রিম দাঁতের চেয়ে হাজার গুণে শ্রেয়।
ওরাল এ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন
কুইক লিংকস
ডেন্টাল ব্লগ পড়ার জন্যে
+880 1726-187603
© 2025. All rights reserved.
Design, Developed & Maintenance by TYL


প্রাইভেসি পলিসি
Terms & Conditions
Privacy Policy
Refund Policy